ঢাকা,রোববার, ৫ মে ২০২৪

কক্সবাজার এলএ শাখায় দুদক আতংক, ভূমি অধিগ্রহণের শত শত চেক দালালের হাতে

ইকবাল হোসেন :: সরকারি প্রকল্পে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণের সরকারি চেক (এলএ চেক) জেলা প্রশাসনের কার্যালয় থেকে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির হাতে হস্তান্তর করা কথা থাকলেও বাস্তবে যাচ্ছে দালালের হাতে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার এসব অনিয়ম ধরা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে। ঘুষের টাকাসহ এলএ শাখার সার্ভেয়ার আটকের ঘটনায় জড়িত এক দালালকে দুদকের মামলায় বুধবার গ্রেপ্তারের পর এ চিত্র ফুটে ওঠে।
সেলিম নামে ওই দালালের ব্যক্তিগত কার্যালয় থেকে ৩৪টি এলএ চেক জব্দ করেন দুদকের মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা। এরপর থেকে কক্সবাজার এলএ শাখায় দুদক আতংকে রয়েছেন কমিশন বাণিজ্যে জড়িত অনেকে। সরকারি ক্ষতিপূরণের চেক দালালের কাছে পাওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কার্যক্রমও।
দুদকের হাতে আটক হওয়া দালালের হাতে ৩৪টি এলএ চেক পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আশরাফুল আবসার গত শুক্রবার দৈনিক আজাদীকে বলেন, গত ৬ মাসে দুয়েকটি ছাড়া কোনো চেক দেওয়া হয়নি। ৬ মাস আগে একটি দুর্ঘটনা (ঘুষের টাকাসহ সার্ভেয়ার গ্রেপ্তার) ঘটার পর আমরা অনেক কঠোর হয়েছি। সেজন্য যাচাই বাছাই করে এলএ চেক বিতরণ করা হচ্ছে।
দালালের হাতে সরকারি এলএ চেক কীভাবে গেল জানতে চাইলে তিনি বলেন, দালালই এ বিষয়ে বলতে পারেন। এলএ চেক ব্যাংকে নগদায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, যাচাই বাছাই করে ব্যাংকে চেক ক্লিয়ার (নগদায়ন) করা হচ্ছে, যাতে কোনো ধরনের সমালোচনা না হয়। তবে অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের সাথে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) বক্তব্যের ভিন্নতা পাওয়া যায়। কারণ করোনা প্রাদুর্ভাবকালীন সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে অফিস খোলার পর থেকে অসংখ্য এলএ চেক ইস্যু হয়েছে। প্রদানও করা হয়েছে অনেককে। গত বৃহস্পতিবারও কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৩০টির মতো চেক ইস্যু হয়েছে।
জানা যায়, কক্সবাজার জেলা ঘিরে কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে সরকার। বিশেষ করে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে পাওয়ার হাব তৈরি হচ্ছে। নির্মিত হচ্ছে বেশ কয়েকটি কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। পাশাপাশি মাতারবাড়ী থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আমদানিকৃত তেল ও গ্যাস সঞ্চালনের লাইন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। নির্মিত হচ্ছে দোহাজারী-ঘুমধুম নতুন রেললাইন। এর মধ্যে বিপিসির সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার এসপিএম প্রকল্প, রেলওয়ের ১৯ হাজার কোটি টাকার দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্প, মাতারবাড়ীতে ৩৮ হাজার কোটি টাকায় পিডিবির কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, দেড় হাজার কোটি টাকায় এলএনজি পাইপলাইন প্রকল্প, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পিবিআইয়ের দপ্তর নির্মিত হচ্ছে।
এসব প্রকল্পের প্রয়োজনে হাজার হাজার কোটি টাকার জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ নিয়ে কক্সবাজার এলএ শাখায় কমিশন বাণিজ্য হচ্ছে গত কয়েক বছরে। কক্সবাজার এলএ শাখার ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলও), কানুনগো, সার্ভেয়ার থেকে শুরু করে অফিসের পিয়নরাও জড়িত কমিশন বাণিজ্যে। এলএ আবেদনের ফাইল নানা হাত ঘুরতেই লাখ লাখ টাকা ঘুষের কারবার।
এলএ শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে রয়েছে প্রায় অর্ধশত দালালের যোগসাজশ। কক্সবাজার জেলার একটি তপশিলি ব্যাংকের ক্যাশ অফিসারও জড়িত রয়েছেন কমিশন বাণিজ্যে। এলএ শাখা মানেই ‘কমিশন বাণিজ্য’, বিষয়টি পুরো কক্সবাজারের ‘টক অব দ্য টাউন’। ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে চিহ্নিত দালালেরা কক্সবাজারের অভিজাত স্থানগুলোতে রীতিমতো অফিস খুলে বসেছেন।
গত ২২ জুলাই কক্সবাজার লালদিঘির পাড়ের হোটেল ইডেন গার্ডেনের নিজ অফিস থেকে শীর্ষ দালাল সেলিমকে গ্রেপ্তার করে দুদক। এসময় তার কাছ থেকে জব্দ করা হয় ৩৪টি সরকারি এলএ চেক, ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য লোকজনের নামে খোলা তফশিলি ব্যাংকের প্রায় অর্ধশত চেক বই। পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি এলএ ক্ষতিপূরণের মূল আবেদনও। একই সাথে ঘুষের টাকা লেনদেনের হিসেব লেখা ডায়েরিও পেয়ে যান দুদক কর্মকর্তারা।
দুদকের কয়েকটি সূত্র বলছে, শুধু দালাল সেলিম নয়, কক্সবাজারের প্রায় অর্ধশত দালালের হাতে গেছে কয়েক হাজার এলএ চেক। এসব চেকে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ। যেখানে ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন বাণিজ্য হয়েছে। কমিশনের এ টাকা দালাল, সার্ভেয়ার, কানুনগোর হাত ঘুরে পৌঁছে যেত শীর্ষ কর্মকর্তাদের হাতে। সূত্র জানায়, পর্যটন নগরী হলেও কক্সবাজার ছোট জেলা। এখানে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) নেই। এলএর দায়িত্বও পালন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)।
সূত্রে জানা গেছে, ১৯ ফেব্রুয়ারি র‌্যাবের হাতে ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকাসহ কক্সবাজার এলএ শাখার সার্ভেয়ার ওয়াশিম খান গ্রেপ্তার হওয়ার পর কক্সবাজার এলএ শাখা আলোচনায় আসে। ওইদিন পৃথক দুই অভিযানে সার্ভেয়ার ওয়াশিম খান ও পলাতক সার্ভেয়ার ফেরদৌস খানের বাসা থেকে বস্তাভর্তি এসব নগদ টাকা উদ্ধারের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের অনেক চেক, ল্যাবটপ, মোবাইল, পাসপোর্ট, এলএ শাখার খতিয়ানের রেজিস্টার এবং এক হাজারের অধিক ভূমি অধিগ্রহণ মামলার (এলএ) মূল আবেদন জব্দ করে র‌্যাব। দুদক আইনের তপশীলভুক্ত হওয়ায় ওই ঘটনায় ১০ মার্চ মামলা করে দুদক। দুদকের দায়ের করা ওই মামলার তদন্তে এলএ শাখার কমিশন বাণিজ্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়াও উঠে এসেছে প্রায় অর্ধশত দালালের নাম। দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে নিয়মিত মনিটরিং চলছে কক্সবাজার এলএ শাখার ঘুষের ওই মামলার তদন্ত। পর্যালোচনার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের অভাবে মামলার তদন্ত কার্যক্রমও চলছে ঢিমেতালে। এদিকে আজ রোববার কক্সবাজার সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে মামলাটিতে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া দুজনের রিমান্ড শুনানির কথা রয়েছে। আসামিরা রিমান্ডে গেলে আরো অনেক রাঘববোয়ালের নাম বেরিয়ে আসতে পারে বলে মন্তব্য দুদকের।
সংশ্লিষ্ট এক দুদক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে বলেন, সার্ভেয়র ওয়াশিম খান ও ফেরদৌস খান হচ্ছেন চুনোপুঁটি। ওখানে কমিশন বাণিজ্যে অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। ক্ষতিপূরণের চেক জমির মালিকের ব্যাংক হিসেবে সরাসরি কিংবা জমির মালিকের হাতে সরাসরি এলএ চেক হস্তান্তর করা কথা। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটা মানা হয়নি। কমিশন নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক একাউন্ট খুলে জমির মালিকের কাছ থেকে আগেভাগে চেক নিয়ে নেওয়া হয়েছে। আবার ঘুষের এসব চেক ক্লিয়ার করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা দেয় কতিপয় ব্যাংক কর্মকর্তা। কারণ এলএ চেক ক্লিয়ার হয়ে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য ব্যক্তির হিসেবে জমা হওয়ার সাথে সাথেই কমিশনের চেক ক্লিয়ার হতো। পুরো বিষয়টিতে নাটকীয়ভাবে সুচারু মিল। যোগসাজশ না থাকলে এ ধরনের মিল পাওয়া দুষ্কর।সুত্র: আজাদী

পাঠকের মতামত: